টিসিবির পণ্য নিয়ে ব্যবসা রাজশাহীতে
তরিকুল ইসলাম তারেক রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি :
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য নিয়ে ট্রাক আসবে সকাল ১০টার পর। কিন্তু সূর্য ওঠার আগেই বিভিন্ন পয়েন্টে নারীদের লাইন। গাড়ি না আসা পর্যন্ত তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু ডাল, চিনি, তেল কিনে সবাই বাড়ি নিয়ে যান না। বেশিরভাগই দোকানে দোকানে বিক্রি করে টাকা নিয়েই বাড়ি ফেরেন।
রাজশাহীতে দীর্ঘ দিন ধরেই এটা হয়ে আসছে। সম্প্রতি নগরীর সাহেববাজারের একটি দোকানে টিসিবির পণ্য জব্দ করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তখন সুমন নামের ওই ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। জব্দ করা হয় টিসিবির পণ্য। সেদিন সুমন জানিয়েছিলেন, এক শ্রেণির নারীরা এসে এসব পণ্য বিক্রি করে যান।
বিষয়টি জানতে পেরে সতর্ক হয়েছে টিসিবি। আগের মতো আর নির্দিষ্ট স্থানেই পরিবেশকদের পণ্য বেচতে দেওয়া হচ্ছে না। ‘ব্যবসায়ী’ নারীদের ফাঁকি দিতে একেক দিন একেক স্থানে পণ্য বিক্রি করতে বলা হয়েছে পরিবেশকদের। গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে এই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু লাভ খুব একটা হচ্ছে না।
টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, তাঁদের লাইসেন্সপ্রাপ্ত পরিবেশক ৬০ জন। পর্যায়ক্রমে প্রতিদিন পাঁচজন পরিবেশককে পণ্য দেওয়া হয় বিক্রির জন্য। আগে সাধারণত সাহেববাজার বড় মসজিদ, আমচত্বর, রেলগেট, সিঅ্যান্ডবি মোড় এবং কাজলা এলাকায় ট্রাক থেকে পণ্য বিক্রি করা হতো। এখন স্থান পাল্টাচ্ছে।
মঙ্গলবার (০৭ সেপ্টেম্বর) নগরীর শিমলা পার্ক, কাজলা রেডিও মাঠ, রাণীবাজার, পোস্টাল একাডেমী এবং উপশহর কাঁচাবাজার এলাকায় পণ্য বিক্রি করা হচ্ছিল। আগের মতো আর নির্দিষ্ট জায়গায় ট্রাক না থামার কারণে কোথায় পণ্য বিক্রি হচ্ছে তা আগাম জানতে পারছেন না ‘ব্যবসায়ী নারীরা’। তবে কিছুটা দেরি হলেও খবর তাঁরা ঠিকই পাচ্ছেন।
সোমবার নগরীর বর্নালী মোড় আমবাগান এলাকায় টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। তাই মঙ্গলবার ভোর থেকে সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন একদল নারী। কেউ কেউ ব্যাগ, ইট, পাথর রেখে লাইন করে রেখেছিলেন। যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের ধারণা, এ দিনও এখানে ট্রাক আসবে। তবে সেই ট্রাকটি চলে গিয়েছিল উপশহর কাঁচাবাজার এলাকায়।
আমবাগানে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজিব চত্বর সংলগ্ন বস্তির বাসিন্দা মজিফা বেগম (৫০)। প্রতিদিন চিনি, তেল, ডাল কেনেন কেন- জানতে চাইলে মজিফা বললেন, ‘কী করব? লিয়্যা যাইয়ি বেচি। দু’পয়সা কামাই হয়।’ মজিফা জানান, ভোর ৬টার দিকে তিনি এসে এখানে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই সকাল সকাল এসে লাইনে দাঁড়ান।
অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা আর পেট চালানোর জন্য মজিফা টিসিবির পণ্য কিনে বেচেন বলে জানালেন। মজিফা যখন কথা বলছিলেন, তখন পাশের আরেক নারীর কাছে মোবাইলে কল আসে। কথা বলার পর তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, গাড়ি গেছে উপশহরে। তারপর কেউ রিকশায়, কেউ পায়ে হেঁটেই উপশহরের দিকে রওনা দিলেন।
শিমলা পার্কে পণ্য বিক্রি করছিল কনা এন্টার প্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির একজন বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘আজ আমরা এখানে হঠাৎ করে এসেছি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সব মুখচেনা মহিলারা এসে হাজির। এঁরা প্রথমে সিএনবি মোড়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিল। কীভাবে যে খবর পেল, জানি না। এখন যে লাইনে দাঁড়াবে, তাঁকে তো দিতেই হবে। প্রতিদিন কিনলেও যে কাউকে দেওয়া যাবে না, এ রকম তো কোন নিয়ম নাই।’
এদিকে এসব ‘ব্যবসায়ী নারীদের’ কারণে প্রকৃত নিম্নআয়ের মানুষ লাইনে দাঁড়ানোর সুযোগই পান না। এঁরা বাড়ির ছোট ছোট শিশুদেরও সঙ্গে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেন। তাঁদের মাধ্যমেও পণ্য নেন। আবার একবার নেওয়া হলে আবার লাইনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। নতুন কাউকে লাইনে দাঁড়াতেই দেওয়া হয় না। কেউ এলে তাঁর সঙ্গে তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়ে দেন এসব নারীরা। নিজেদের মধ্যেও লাগে ঝগড়া। তারপর একেকজন কয়েকবার তেল, চিনি, ডাল সংগ্রহ করে নিয়ে বিক্রি করেন। কেউ বিক্রি করেন মহল্লার দোকানে, কেউ বিক্রি করেন প্রতিবেশীদের কাছে।
টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান রবিউল মোর্শেদ পণ্য নিয়ে নারীদের এ ধরনের ব্যবসার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই ব্যবসা বন্ধ করার জন্য আমরা এখন একেক দিন একেক স্থানে গাড়ি রাখার ব্যবস্থা করেছি। শুধু ওদের ফাঁকি দিতেই এই কৌশল। এতে কিছুটা লাভ হয়েছে। আমরা চাই প্রকৃত অসহায় মানুষই কম মূল্যে পণ্য কিনুক। এটা নিশ্চিত করতে আর কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে সেটা আমরা ভাবছি।’
টিসিবি জানিয়েছে, আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ট্রাক থেকে পণ্য বিক্রি চলবে। প্রতিদিন একজন পরিবেশককে ৪০০ কেজি মসুর ডাল, ৫০০ কেজি চিনি এবং ৬০০ লিটার তেল দেওয়া হচ্ছে। একজন ক্রেতা ১০০ টাকা দরে সর্বোচ্চ পাঁচ লিটার তেল এবং ৫৫ টাকা দরে দুই কেজি করে মসুর ডাল ও চিনি কিনতে পারবেন।