বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৮ অপরাহ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ১০০ বছর

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১ জুলাই, ২০২১
  • ১৮৩ বার পঠিত

 

স্টাফ রিপোর্টার জসীমউদ্দীন ইতি

একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনবদ্য ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পূর্ণ করল। এ ভূখণ্ডের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টির আজ
জন্মদিন। জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হয়ে আজ ১০১ বছরে পা দিল এ জাতির বাতিঘর।
দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে অবহেলিত এ অঞ্চলে একটি উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি তৈরিতে
নেতৃত্ব দিয়েছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। এখানকার
ছাত্র-শিক্ষকরা জাতির মানস গঠনে ছিলেন পথপ্রদর্শক।
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে
বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জাতির
পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। তাই এই আনন্দঘন মুহূর্তে
এবার দেশ এবং প্রবাসে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান
শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরাজ করছে বাড়তি উচ্ছ্বাস-উল্লাস। তবে করোনা
মহামারি এই উল্লাস প্রকাশের পথে অনেকটাই বাদ সেধেছে। তাই নানা পরিকল্পনা
থাকলেও শেষ পর্যন্ত কাটছাঁট করা হয়েছে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায়।

ঔপনিবেশিক আমলে বঙ্গভঙ্গ রদের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় ঘটনার আবর্তে ১৯২১
সালের ১ জুলাই রমনার সবুজ প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গের প্রথম
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন,
আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের স্বাধীনতা
সংগ্রামসহ বাঙালির প্রতিটি গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের সূতিকাগারের মতো ভূমিকা
রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ১৬ মাস ধরে বন্ধ আছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এ কারণে এমন দিনেও আজ জাঁকজমকপূর্ণ কোনো কর্মসূচি আয়োজন করেনি
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সীমিত পরিসরে প্রতীকী কর্মসূচির মাধ্যমে শতবর্ষ
পূর্তির মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে। এর নাম দেওয়া হয়েছে অগ্রবর্তী অনুষ্ঠান।

আগামী নভেম্বর মাসে শতবর্ষের আনুষ্ঠানিকতা উদযাপনের সিদ্ধান্ত আছে বলে
জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। ওইদিন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে শতবর্ষের মূল অনুষ্ঠান বর্ণাঢ্য
ও জাঁকজমকপূর্ণভাবে আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ এতে প্রধান অতিথি হিসাবে
উপস্থিত থাকবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপনলগ্নে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন
উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। পাশাপাশি অভিনন্দন জানিয়েছেন বর্তমান
ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে। তিনি বলেন,
জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাথা নিয়ে শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে প্রাণপ্রিয় এই
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চিরগৌরবময় মুক্তিযুদ্ধসহ
গণমানুষের সব লড়াইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদা নেতৃত্ব দিয়েছে।
জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং দেশ সেবায় রেখেছে অনন্য অবদান।

দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা জানান, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষাদীক্ষায়
উন্নত মান বজায় রাখার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি অভিধা পেয়েছে ‘প্রাচ্যের
অক্সফোর্ড’ হিসেবে। পাশাপাশি এটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালুর ২৬ বছরের মধ্যে ব্রিটিশদের কবল থেকে উপমহাদেশ
মুক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র। সেই
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম
বাংলাদেশের। পাকিস্তান সৃষ্টির পরের বছর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়
স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সৃষ্টির আন্দোলনে নিবেদিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে,
দেশ স্বাধীন এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ গঠন ও পরিচালনায় যারা ভূমিকা
রেখেছেন তাদের ৫০ বছর ধরে তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২
সালে শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ,
বাঙালির মুক্তির সনদখ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি আদায়, ১৯৬৯ সালের
গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভূমিকা ছিল।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর আশির দশকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পরে
এরশাদবিরোধী আন্দোলন সূচিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গণতান্ত্রিক
সরকারগুলোকে সঠিকপথে রাখতে ছোটখাটো আন্দোলন আর একাডেমিক সমালোচনায়
নেতৃত্ব দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে গণতন্ত্র মুক্তির
আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গও বিচ্ছুরিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এসব
কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষায় অবদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক
পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েও সমান আলোচনা হয়ে থাকে।

ইতিহাসের পাতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে
পূর্ববাংলা ও আসামকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করেছিল ব্রিটিশরাজ।
হিন্দু জমিদারসহ প্রভাবশালীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে পরে সেই বঙ্গভঙ্গ
রদ করতে হয়েছিল। তবে বঙ্গভঙ্গ বাতিলের রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে পরে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইতিহাসে আরও দেখা যায়, প্রভাবশালীরা তখন
এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিল।

কিন্তু ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরেবাংলা
একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন মুসলিম নেতারা ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে এ নিয়ে
দেনদরবার করেন। এ লক্ষ্যে তখনকার ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জের সঙ্গে বিশিষ্ট
নেতারা ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি সাক্ষাৎ করেন। এর তিন দিন পর ২ ফেব্রুয়ারি
ভাইস রয়ের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা আকারে প্রকাশ পায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার
লক্ষ্যে ওই বছরই ২৭ মে নাথান কমিশন গঠন করা হয়।

এ অবস্থায় প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা কার্যক্রম
থমকে যায়। যুদ্ধ শেষে ফের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন এ অঞ্চলের
মুসলিম নেতারা। এ অবস্থায় ১৯১৭ সালের নভেম্বরে ব্রিটিশ সরকার ‘স্যাডলার
কমিশন’ গঠন করে। দুই বছর পর ১৯১৯ সালের মার্চে স্যাডলার কমিশনের রিপোর্ট
প্রকাশ পায়। এরপর ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ দি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট
নামে ভারতীয় আইনসভায় পাশ হয়। সেই আইন অনুযায়ী ১৯২১ সালের ১ জুলাই
ছাত্রছাত্রীদের জন্য দ্বারোন্মোচন হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ঢাকায় ওই সময়ের সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা ছিল রমনা। ওই
এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছিল এই ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ ছিল। একটি
পরিপূর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। আবাসিক হলগুলো
হচ্ছে- সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা হল-যা এখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ও
জগন্নাথ হল। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল
৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন।

আর শতবর্ষ পরে আজকে এই বিশ্ববিদ্যালয় মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে
অনুষদ ১৩টি, বিভাগ ৮৪টি, ইনস্টিটিউট ১৩টি, গবেষণা ব্যুরো ও কেন্দ্র ৬১টি।
আবাসিক হল ১৯ এবং হোস্টেল ৪টি। আর শিক্ষার্থী ৪৬ হাজার ১৫০ জন ও শিক্ষক
২০০৮ জন। কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৪ হাজার ৪৫৫ জন। এমফিল গবেষক ১১৬১ ও ও
পিএইচডি গবেষক আছেন ১০৪৩ জন। এখন পর্যন্ত এমফিল ডিগ্রি পেয়েছেন ১৭০৮ ও ও
পিএইচডি ১৫৮৮ জন পেয়েছেন।

সম্প্রতি ডিবিএ (ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) ডিগ্রিও প্রদান করা
হচ্ছে। ৬০০ একরে ক্যাম্পাস যাত্রা করলেও বর্তমানে এর পরিধি ২৭৫ দশমিক ৮৩
একর। সম্প্রতি সরকার পূর্বাচলে ৫১.৯৯ একর জমি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে বরাদ্দ
দিয়েছে। কৃতী শিক্ষার্থীদের মেডেল, বৃত্তি ও সম্মাননা দিতে বিশিষ্ট
ব্যক্তিদের নামে ট্রাস্ট ফান্ড আছে ৩৪৭টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ মনে করেন, মানের দিক দিয়ে
বাংলাদেশে সব ক্ষেত্রে যে অবনমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বাইরে নয়। তবে
দেশে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই এগিয়ে। গবেষণাপত্রের সংখ্যায় ও বৈশ্বিক
র্যাঙ্কিংয়ে দেশের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই সবার ওপরে থাকে। এর বিপরীত
মত হলো, সব ক্ষেত্রে যখন অবনমন, তখন পথ দেখানোর ভূমিকা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে। দেশের এখন দরকার শিক্ষার মান ও গবেষণায়
উন্নতি। সেখানে এগিয়ে যেতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষক
ও ইউজিসি অধ্যাপক হাসিনা খান, যিনি সম্প্রতি পাট থেকে নতুন ধরনের
অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করে সাড়া ফেলেছেন, তিনি
বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা খুব ভালো ছিল, কিন্তু মাঝপথে আমরা হারিয়ে
গেছি।’

এই অধ্যাপক মনে করেন, উঁচু মানের শিক্ষক-গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
রয়েছেন। তবে গবেষণায় জোর দেওয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের পড়ানোর মধ্য দিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বকে কী দিচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের কর্মসূচি: আজকের প্রতীকী কর্মসূচির মধ্যে আছে-সকাল সাড়ে ১০টায়
বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে জাতীয় পতাকা ও
বিশ্ববিদ্যালয়ের পতাকা উত্তোলন। অনুষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইপি
টেলিভিশনে সম্প্রচার এবং ওয়েবসাইট ও ফেসবুক লাইভে সম্প্রচার করা হবে।
বিকাল ৪টায় প্রশাসনিক ভবনে অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী ভার্চুয়াল
ক্লাসরুমে আলোচনা সভা হবে। এতে ভাষাসৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সংযুক্ত
হয়ে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করবেন। সভাপতিত্ব করবেন উপাচার্য অধ্যাপক ড.
মো. আখতারুজ্জামান।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এ জাতীয় আরো খবর..