সাভার উপজেলা প্রতিনিধি:
সাভার হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সীমাহীন অনিয়ম আর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল নিজেদের মনগড়া নিয়মে চালাচ্ছেন কলেজ। ২০১৬ সালে সরকারি অনুমোদন পেলেও সরকারি নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেন তারা। কলেজ পরিচলনা কমিটিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তার স্ত্রী ও ৭ মাস পূর্বে মৃত বাবার নাম ভাইস প্রিন্সিপালসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে। যার মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।
এখানে নিয়মানুযায়ী কমিটি বলতে কিছুই নেই। আবার নিয়ম ভঙ্গ করে প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল বেতন নিলেও শিক্ষকদের কোন প্রকার বেতন দেওয়া হচ্ছে না। অথচ শিক্ষক নিয়োগে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা কলেজের উন্নয়নের নামে অনুদানের জন্য রশিদ প্রদান করে নেওয়া হয়েছে। রশিদের বাহিরেও টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিয়ম ভঙ্গ করে সরকারি চাকরিজীবী ও অন্যত্র কর্মরত এমন ব্যক্তিদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ছাত্র ছাত্রীদের রুটিন মাফিক ক্লাসে উপস্থিত করাতে কর্তৃপক্ষের কোন গরজ নেই। তবে ছাত্র ছাত্রীদের অভিযোগ তারা কলেজে আসলেও ক্লাস হচ্ছে অনিয়মিত। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আউটডোরে নিয়মিত রোগী দেখার নিয়ম থাকলেও তা কখনও করা হচ্ছে না। তবে নিয়ম রক্ষায় একাধিক বেড সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা হয়েছে।
অভিযোগে জানাগেছে, হোমিওপ্যাথিক বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সরকারি চাকরি হতে নির্দিষ্ট বয়সসীমা অতিক্রম করার পর অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি সরকার অনুমোদিত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালনে আইনগত বৈধতা নেই। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সাভার হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে আব্দুল ওয়াদুদ দায়িত্ব পালন করছেন। নিজস্ব জমি না হওয়া পর্যন্ত কলেজের শিক্ষকরা বেতন নিতে পারবেন না মর্মে বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া কলেজের একাধিক সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও প্রিন্সিপাল কামাল হোসেন ও ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল ওয়াদুদ নিয়মিত বেতন গ্রহণ করছেন।
কলেজটিতে বর্তমানে প্রথম বর্ষে ৪৫ জন দ্বিতীয় বর্ষে ৭০ জন তৃতীয় বর্ষে ১০০ জন ও চতুর্থ বর্ষে ১০৯ জন শিক্ষার্থীসহ ৩২৪ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এ সকল ছাত্র ছাত্রীদের নিকট হতে প্রতি মাসে মাসিক বেতন ১০০০ টাকা করে আদায় করা হয়। সে হিসেবে মাসিক বেতন আদায় হচ্ছে ৩ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এছাড়াও ছাত্র ছাত্রীদের নিকট হতে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার সময় জন প্রতি ১০০০ টাকা আদায় করা হয়। এর বাহিরে কেন্দ্র ফি, প্রবেশ পত্র প্রদান বাবদ অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। একই ব্যবহারিক খাতা একাধিক বার বিক্রয়, এ্যাপ্রোন বিক্রয়, আইডি কার্ড বিক্রয়, প্রি-টেস্ট পরীক্ষা বাবদ, বই বিক্রয় বাবদসহ নানা ছলচাতুরি করে ছাত্র ছাত্রীদের নিকট হতে টাকা আদায় করা হচ্ছে। যার সিংহ ভাগ ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল নিজেদের পকেটস্থ করেন। অভিযোগ রয়েছে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল কামাল হোসেন সাভার পৌর এলাকার ব্যাংক কলোনী মাদরাসা মসজিদের নিকট ৬ তলা বাড়ি, একাধিক প্লট, আশুলিয়ার জামগড়ায় বাড়ি ও বাড়ি সংলগ্ন মার্কেট গড়েছেন। ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল ওয়াদুদের পৌর এলাকার রাজাশনে বহুতল বিশিষ্ট দুটি বাড়ি ও নামে বেনামে একাধিক প্লট রয়েছে।
শিক্ষক আশরাফুল হক, দবির হোসেন, জাহাঙ্গীর হোসেন, মিন্টু মিয়া, আবু তালহাসহ বেশ কয়েকজন জানান, অনেক কষ্ট ও ধার দেনা করে টাকা জোগাড় করে দিয়েছি। অথচ তাদেরকে কোন প্রকার বেতন ভাতা প্রদান করা হচ্ছে না। বেতন না পেয়ে অধিকাংশ শিক্ষক মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
নিয়োগকালে রশিদের বাহিরেও অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে। অপরদিকে বিধি লঙ্ঘন করে একাধিক শিক্ষক সাভার হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চাকরি করছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল ওয়াদুদ আনবিক শক্তি কমিশনে সরকারি চাকরি করাকালীন ১৯৯৪ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠাকালীন সময় হতে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এমনকি ২০১০ সালে চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করার পরে অদ্যবধি কর্মরত রয়েছেন এবং বেতন ভাতা গ্রহণ করছেন। কলেজটির অবৈধ ম্যানেজিং কমিটির বদৌলতে ৭১ বছর বয়সেও তিনি চাকরিতে বহাল রয়েছেন। এছাড়া অপর শিক্ষক রেজাউল করিম মোল্লা সাভার পৌরসভার কর সেকশনে চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক বোর্ড রেগুলেশন ১৯৮৫ এর ৮ (এইচ) এর ধারা লঙ্ঘন করে ম্যানেজিং কমিটির রেজিস্টার্ড চিকিৎসক পদে তাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। কিন্ত বিধি অনুযায়ী তার এ পদে থাকার কোন বৈধতা নেই।
কলেজটি ১৯৯৪ সালে স্থাপিত হওয়ার পর কৌশলগত কারণে প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল ৫ বার স্থান পরিবর্তন করেছেন। বর্তমান সাভার পৌর এলাকার জাহাঙ্গীরনগর হাউজিং সোসাইটির প্রবেশ পথের নিকট জালেশ্বরে একটি আবাসিক ভবনের নীচতলা ও চতুর্থ তলায় ৮টি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চলছে সাভার হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। তার মধ্যে ৩টি কক্ষ অফিসের জন্য ৩টি কক্ষ শ্রেণি কক্ষের জন্য ও ২টি কক্ষ আউটডোরের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
কলেজটি শর্ত সাপেক্ষ ২০১৬ সালে অনুমোদন পেলেও শর্তগুলো পালন করা হচ্ছে না। অন্যতম শর্ত হচ্ছে ৫ বছরের মধ্যে নিজস্ব জায়গায় কলেজ স্থাপিত হতে হবে। কিন্তু জমি ক্রয়ের জন্য টাকা থাকলেও কর্তৃপক্ষ এ সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরেও জমি ক্রয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। কলেজটিতে বর্তমানে ৩৬জন শিক্ষক রয়েছে। পাশাপাশি ৭জন খন্ডকালিন শিক্ষক কলেজটিতে কাজ করছেন। বর্তমানে কলেজ পরিচলনা কমিটি বলতে একটি পকেট কমিটি বিদ্যমান। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কামাল হোসেন কমিটিতে তার স্ত্রী ও ৭ মাস পূর্বে মারা যাওয়া তার বাবা সাহাজ উদ্দিনের নাম ও ভাইস প্রিন্সিপাল আব্দুল ওয়াদুদসহ কয়েকজনের নাম রয়েছে। এ কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখানে নিয়মানুযায়ী কমিটি বলতে কিছুই নেই।
কলেজটির শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জানান, দীর্ঘ চেষ্টার পর ২০১৬ সালে অনুমোদন পাওয়ার পর কলেজটি আবার অনুমোদনহীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তিনি বলেন, কলেজটির আয় ব্যয়ের সাথে যারা জড়িত তারা কলেজের আভ্যন্তরীণ অডিট কমিটিতে থাকতে পারেন না কিন্তু ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল নিজেদের গঠিত কমিটির জোরে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অডিট সম্পন্ন করাচ্ছেন।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে কলেজের নানা দুর্নীতির কথা লিখিত আকারে বিভিন্ন দফতরে প্রেরণ করা হয়েছে।