সাইকেল জাদুঘর
জসীম উদ্দিন ইতি
দ্বিচক্রযানের বর্তমান ধারাটি মাউন্টেন, হাইব্রিড, ট্রায়াথন,
বিএমএক্স কিংবা ট্রেকসহ নানা আধুনিক মডেলের। এসব নামের ভিড়ে কল্পনাও করা
যাবে না একসময় মাটিতে পা ফেলে দৌড়ে দৌড়ে চালাতে হতো সাইকেল। তখন সাইকেল
ছিল কাঠের। চেইন, ব্রেক কিংবা গিয়ার কিছুই ছিল না। যুক্তরাজ্যের জাতীয়
সাইকেল জাদুঘরে সংরক্ষিত আদি সাইকেলগুলো দেখে তাই চোখ কপালে ওঠার জোগাড়।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় সাইকেল জাদুঘরটি ওয়েল রাজ্যের ল্যানড্রিনডোড ওয়েলস
এলাকায়। এই জাদুঘরের যেদিকেই চোখ যায়, কেবল নানা ঢঙের বাইসাইকেল। কোনোটি
কাঠের, কোনোটি লোহার, কোনোটির এক চাকা বিশাল তো আরেক চাকা ছোট্ট। আছে তিন
চাকার কিংবা একাধিক আসনের বাইসাইকেল। সবমিলে ২৬০টির বেশি সাইকেল আছে এই
জাদুঘরে। প্রদর্শনী দেখে আন্দাজ করা যায় কতটা পথ মাড়িয়ে বর্তমান রূপে
আবির্ভূত হয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে সমাদৃত
এই দ্বিচক্রযান। সাইকেলের জন্মকথা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যের ওপর ভরসা
করা কঠিন।
এই জাদুঘরের তথ্য অনুযায়ী, মানুষ সব সময় দ্রুত চলার উপায় খুঁজেছে। এরই
ধারাবাহিকতায় ১৮০০ শতকের শুরুর দিকে এসে একটি দ্বিচক্রযান ব্যাপক পরিচিতি
পায়। সামনে পেছনে কাঠের দুই চাকা। ওপরে বসার পাটাতন। মাটিতে পা ফেলে
অনেকটা দৌড়ের মতো করে এই সাইকেল চালাতে হতো। এর ইংরেজি নাম ছিল হোবি
হর্স। ১৮১৭ সালে জার্মানির কার্ল ভন দ্রাইস এটি আবিষ্কার করেন। সাইকেলে
সমান্তরাল দুটি চাকা এবং স্টিয়ারিং দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার এটিই প্রথম
সূচনা।
হোবি হর্সের পর ১৮৬০ সালের আগ পর্যন্ত এই দ্বিচক্রযানে কারিগরিগত খুব
একটা পরিবর্তন আসেনি। ১৯৬০ এর দশকে হোবি হর্সের সামনের চাকায় ক্রাঙ্ক এবং
প্যাডেল যুক্ত করা হয়। এটি আরোহীকে মাটি থেকে পা তুলে প্যাডেলে রাখার
কিছুটা আরাম করে দেয়। ভেলোসিপেড নামে পরিচিত ছিল এটি। সত্তর দশকে সাইকেলে
প্রথমবারের মতো ধাতব রিংয়ের চাকা যুক্ত হয়। দ্য অর্ডিনারি নামে পরিচিত এই
সাইকেলের সামনের চাকা পেছনের চাকার তুলনায় অনেক ছোট। বড় আকারের পেছনের
চাকায় যুক্ত হয় ক্রাঙ্ক এবং পাডেল।
এই দ্বিচক্রযানের বর্তমান বিকাশ ঘটে আশির দশকে। দ্য সেফটি বাইক নামে
পরিচিত ওই সাইকেল ছিল লোহার ফ্রেমে বাঁধাই করা। পেছনের চাকায় যুক্ত হয়
চেন। আর ক্রাঙ্ক এবং প্যাডেল দুই চাকার মাঝামাঝি। পায়ের চাপে ইচ্ছামাফিক
এগিয়ে চলা এই বাইকের আবির্ভাব মানুষের নিত্য যাতায়াতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন
আনে। এমনকি ইউরোপে পুলিশের দায়িত্ব পালনে সাইকেল হয়ে উঠে অন্যতম বাহন।
এরপর সময় যত গেছে, এই দ্বিচক্রযান হয়েছে আরও নান্দনিক ও আরামদায়ক। হয়েছে
নানা আকার ও প্রকারের। উদ্দেশ্যভেদে হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন। যেমন রেসিং
সাইকেল, বিচ সাইকেল ইত্যাদি। এই জাদুঘরে আরও শত রকমের সাইকেলের দেখা
মেলে। যেমন ‘সোসিয়েবল সাইকেল’। বাংলায় বলা যায় সামাজিক সাইকেল। দুজন
আরোহী পাশাপাশি বসে এটি চালাতে পারেন।
ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের যুবক-যুবতীদের কাছে এই সাইকেল ছিল বেশ জনপ্রিয়।
টেনডেম সাইকেলে লম্বা ফ্রেমে যুক্ত দুই চাকা। আছে সারিবদ্ধ একাধিক আসন।
আসনভেদে দশজন পর্যন্তে এতে চড়তে পারেন। ‘রিকামবেন্ট’ সাইকেল আরোহী হেলান
দিয়ে আয়েশ করে চালাতে পারেন। আর ‘ট্রাইসাইকেল’ হলো অনেকটা পেছনের আসন ও
হুডিবিহীন রিকশার মতো। আর ভাঁজ করে বহনের উপযোগী ‘ফোল্ডিং সাইকেল’ তো
আছেই।
১৯৯৭ সালে সাইকেল জাদুঘর হিসেবে এটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। তখনো
যুক্তরাজ্যের জাতীয় সাইকেল জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃত ছিল লিঙ্কনে অবস্থিত
একটি জাদুঘর। ১৯৯৮ সালে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লিঙ্কনের সাইকেলগুলো
স্থান পায় প্রায় ১২০ বছরের পুরোনো অটোমোবাইল প্যালেসে। সেই থেকে এটিই
দেশটির জাতীয় জাদুঘর হিসেবে স্বীকৃত।