তরিকুল ইসলাম তারেক রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি
রাজশাহীতে লাশেই হচ্ছে লাখ টাকার বাণিজ্য! লাশের অপেক্ষায় শকুনের মতো দাঁড়িয়ে সারিসারি অ্যাম্বুলেন্স। এদের এজেন্ট রয়েছে হাসপাতলের ভেতরেও। ট্রলিতে লাশ উঠিয়ে ছাড়পত্র নেওয়া থেকে গাড়িতে উঠানো পর্যন্ত এদের কাজ। এরপর মৃতের স্বজনের কাছে ভাড়া হাঁকা হয় আকাশছোঁয়া!
রাজশাহীতে করোনায় মৃতের লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন একের পর এক লাশ বের হচ্ছে হাসপাতাল থেকে। প্রাণপাখি উড়ে গেলেও রক্ষা নেই লাশের। পড়তে হচ্ছে একদল সিন্ডিকেটের খপ্পরে। স্বজনদের গুণতে হচ্ছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ ভাড়া। রোগি নিয়ে কোন গাড়ি আসলেও খালি ফেরৎ যেতে হয় তাকে।
সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সামনে থাকা লাশ টানা গাড়ির সিন্ডিকেট যার কাছে যে রকম পারছে ভাড়া হাঁকছে। করোনাকালে তারা একরকম ডাকাতিই শুরু করেছে। সাধারণ রোগীর কাছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা নিলেও লাশের খবর শুনলেই ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনে কোনো ব্যক্তি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তাঁদের লাশ বাড়িতে পৌছে দিচ্ছে সিটি করপোরেশনের অ্যাম্বুলেন্স। অপরদিকে লাখ টাকার বাণিজ্য করছে অ্যাম্বুলেন্স মিন্ডিকেট।রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল এলাকার কিছু মানুষ চান, হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসুক মরদেহ। মরদেহ নিয়ে দরদাম করেন এসব লোকজন। তারাই মূলত মরদেহবাহী মাইক্রোবাস ও অ্যাম্বুলেন্সের মালিক-চালক।
স্বাশকষ্ট নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ শিবগঞ্জের আইনাল হক। সোমবার সকালে করোনা আইসোলেশন ইউনিটে মারা যান তিনি। বাড়ি পৌঁছাতে তার পরিবারকে গুনতে হবে তাদের ১৩ হাজার টাকা।
তার পরিবার জানান, রাজশাহী থেকে তাদের বাড়ির দূরত্ব প্রায় ১১০ কিলোমিটার। মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সকে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১৩ হাজার টাকা। এর কমে তারা যাবেন না। এখন উপায় নেই। করোনায় মারা যাওয়ায় অন্যকেউ মরদেহ নিতে চান না। আবার হাসপাতাল এলাকায় মরদেহবাহী মাইক্রোবাস চালকদের সিন্ডিকেট অন্য মাইক্রোবাস আসতেও বাধা দিচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের সামনের রাস্তা দখল করে সারিসারি গাড়ি সাজানো। চক্রটি এতই প্রভাবশালী যে এই চক্রের গাড়ি ছাড়া এবং তাদের চাওয়া দামের কমে অন্য কোনো গাড়িতে লাশ তোলা যায় না। প্রয়োজনে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে লাশ বহনের ব্যবস্থা করা হয়। অপরদিকে লাশ বহনকারী গাড়ির জন্য কিলোমিটারপ্রতি নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা হাসপাতাল প্রাঙ্গণে টাঙিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক এই হাসপাতালে ২০ থেকে ২৫ জন রোগী মারা যায়। ওয়ার্ডে একজন রোগীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির চক্রের লোকেরা খবর পেয়ে যান। তাঁরা ওয়ার্ডে গিয়ে হাজির হন। কোনো গাড়ির মালিক একবার যে ভাড়া হাঁকেন, অন্য কেউ তার নিচে ভাড়া চান না। কারোনা-কালে তাঁরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন এভাবে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা শুধুমাত্র অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া যায় রোগী কিংবা মৃতের স্বজনদের। স্বাভাবিক সময়ে এই টাকার পরিমাণ ১০ লাখের বেশি হয়ে থাকে বলে জানায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক অ্যাম্বুলেন্স চালক।
রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে তারা তিন থেকে চারগুন বাড়তি ভাড়া আদায় করে আসছেন। বার বার উদ্যোগ নিয়েও এ চক্রকে ভাঙতে পারেনি স্বয়ং প্রশাসন।
তবে নৈরাজ্য দমনে গত বছরের মার্চে মাইক্রোবাস মালিক ও চালকদের সঙ্গে বৈঠক করে প্রতি মাইল ৩০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করে রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই সময় বৈধ ৬৬টি মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতাল চত্ত্বরে প্রবেশের অনুমতি পায়। তারপরও নিয়ম ভেঙে হাসপাতালের ভেতরেই অবস্থান করছে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলো।
আর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স কিংবা মাইক্রোবাস অবস্থান নিয়েছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের প্রধান ফটকের বাইরের সড়কে। রোগী কিংবা মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের হলেই জিম্মি করছেন এ চক্রের সদস্যরা। এ নিয়ে প্রায়ই ঘটছে অপ্রীতিকর ঘটনা। তবে চালকরা দাবি করছেন, আগের তুলনায় এখন ভাড়া কম।
এ বিষয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস বলেন, ভাড়া বেশি নেওয়ার কথা নয়। এমনটা জানতে পারলে সেই গাড়িকে অবশ্যই আর হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, বিষয়টি তারা পুলিশকে জানিয়েছেন। যারা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনত ব্যবস্থা নেবে।
Like this:
Like Loading...
Related
এ জাতীয় আরো খবর..