স্টাফ রিপোর্টার জসীমউদ্দীন ইতি
ভারতে গত রোববার অনেক মুসলিম নারী হঠাৎ দেখতে পান অনলাইনে বিক্রির
জন্য তাদের নিলামে তোলা হয়েছে। ঐ অ্যাপে ব্যবহারকারীদের বলা হয় যে,
অনলাইনে একজন ’সুল্লি’ কেনার এখনই সুযোগ। ভারতে উগ্র হিন্দুদের অনেক
ট্রলে মুসলিম নারীদের অবমাননা করতে ‘সুল্লি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। ঐ
অ্যাপে আসলে কোনো অকশান বা নিলাম হয়নি। অ্যাপটি খোলার আসল উদ্দেশ্য ছিল
মুসলিম নারীদের ছোট করা, অপমান করা, অপদস্থ করা।
যারাই সোচ্চার তারাই টার্গেট হচ্ছেন। পেশাদার পাইলট অর্থাৎ বিমান চালক
হানা মোহসিন খানও অন্য অনেকের মত হঠাৎ আবিষ্কার করেন তিনিও বিক্রির
তালিকায়। বিবিসিকে হানা খান বলেন, তার এক বন্ধু তাকে একটি টুইট
ফরোয়ার্ড করে এই ঘটনা জানায়। টুইটের ঐ লিংকে ক্লিক করার পর সেই লিংক
তাকে ‘সুল্লি ডিলস’ নামে একটি অ্যাপ এবং তাদের ওয়েবসাইটে নিয়ে যায়।
সেখানে ঢুকে তিনি দেখেন পান কয়েকজন পরিচিতসহ অনেক নারীর ছবি দিয়ে লেখা
রয়েছে ‘আজকের ডিল’ অর্থাৎ এদেরকে আজ বিক্রি করা হবে।
হানা খান প্রথমেই অ্যাপটির যে পেজে ঢোকেন – সেখানে ছিল অচেনা এক নারীর
ছবি। পরের দুই পাতায় তিনি তার কয়েক বন্ধুর ছবি এবং প্রোফাইল দেখতে পান।
তার পরের পাতাতেই দেখতে পান তার নিজের ছবি এবং পরিচিতি। ‘আমি নিজে ৮৩টি
নাম গুনেছি। আরো হয়তো থাকতে পারে,’ বিবিসিকে বলেন হানা খান। ‘তারা আমার
ছবি নিয়েছে আমার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে কারণ ছবির সাথে আমার টুইটারের
ইউজার-নেম ছিল। ঐ অ্যাপটি ২০দিন ধরে অনলাইনে ছিল, কিন্তু আমরা তা জানতেই
পারিনি। দেখে আমার মেরুদণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যায়।’ হানা খান বলেন, তাকে
টার্গেট করা হয়েছে – কারণ তিনি মুসলিম। ‘আমি একজন মুসলিম নারী যে
সোচ্চার এবং যাকে চোখে পড়ে,’ তিনি বলেন, ‘সুতরাং তারা আমার মুখ বন্ধ
করতে চায়, আমাকে অপদস্থ করতে চায়, ভয় দেখাতে চায়।’
গিট হাব নামে যে অনলাইন প্লাটফরমে থেকে এসমস্ত ওপেন সোর্স অ্যাপ জায়গা
পায় -তাদের কাছে অভিযোগ করার পর তারা সুল্লি ডিল অ্যাপটি বন্ধ করে
দিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক মুসলিম নারী যাদেরকে টার্গেট করা হয়েছে,
– তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঐ অ্যাপে বিক্রির জন্য যেসব
মুসলিম নারীদের তালিকায় তোলা হয়েছিল তারা সবাই বেশ সোচ্চার। তাদের
মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, অধিকার কর্মী, শিল্পী, গবেষক। এদের কেউ কেউ এর
মধ্যেই তাদের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। অনেকে ভয়
পাচ্ছেন এমন আরো হেনস্থা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
‘আপনি মানসিকভাবে যত শক্তই হোননা কেন, আপনার ছবি এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন
তথ্য যদি জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়, আপনি আতঙ্কিত হবেন, উদ্বিগ্ন হবেন,’
বিবিসিকে বলেন আরেক মুসলিম নারী। তবে সুল্লি অ্যাপে যাদের অপদস্থ করা
হয়েছে তাদের সবাই ভয়ে চুপ মেরে যাননি। তাদের অনেকেই তাদের সোশ্যাল
মিডিয়া পেজে এসব ‘বিকৃত’ মানসিকতার মানুষদের দেখে নেওয়ার সংকল্পের কথা
লিখেছেন। নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা আদান-প্রদানের লক্ষ্যে তাদের জনা বারো
নারী হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপও খুলেছেন, যাদের মধ্যে হানা খানও রয়েছেন।
তারা পুলিশের কাছে একটি অভিযোগও দায়ের করেছেন।
নাগরিক সমাজের অনেক প্রতিনিধি এবং অধিকার কর্মী মুসলিম নারীদের এভাবে
অপমান করার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। পুলিশ জানিয়েছে, তারা তদন্ত শুরু
করেছে তবে এই অ্যাপ তৈরি এবং তা নিয়ে এ ধরণের তৎপরতার পেছনে কে বা কারা
রয়েছে – তা নিয়ে মুখ খোলেনি। যারা অ্যাপটি তৈরি করে অনলাইনে ছেড়েছে
তারা নকল নাম-পরিচয় ব্যবহার করেছে। কিন্তু হাসিবা আমিন – যিনি বিরোধী দল
কংগ্রেসের সোশ্যাল মিডিয়া সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করেন – বলেন,
কট্টরপন্থী রাজনীতির সমর্থক বেশ কয়েকটি অনলাইন আ্যাকাউন্ট থেকে নিয়মিত
মুসলিম বিদ্বেষী প্রচারণা চালানো হচ্ছে, বিশেষ করে মুসলিম নারীদের
টার্গেট করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এভাবে অনলাইনে মুসলিম নারীদের অপদস্থ করার
এরকম ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৩ই মে ঈদুল ফিতরের দিন ইউটিউবের একটি
চ্যানেলে ‘ঈদ স্পেশাল’ নামে এক অনুষ্ঠান হয় যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের
মুসলিম নারীদের নিলামে তোলা হয়েছিল।
হানা খানও ছিলেন ইউটিউবে নিলামে তোলা ঐ নারীদের একজন। ‘মানুষজন একেক
নারীর জন্য পাঁচ রুপি, ১০ রুপি বিড করছিল। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের রেটিং
করছিল, তাদের সাথে কাল্পনিক সংগমের রগরগে বর্ণনা দিচ্ছিল, ধর্ষণ করার
হুমকি দিচ্ছিল, ‘ বলেন হানা খান। ইউটিউবে ঐ চ্যানেলের সাথে যোগ হয় আরো
কয়েকটি টুইটার অ্যাকাউন্ট – যার একটি নাম ছিল সুল্লিডিলস১০১ – যেগুলো
পরে বন্ধ করে দেয়া হয়।
সুল্লি ডিলস অ্যাপটি তৈরির দাবি যে সব টুইটার আ্যকাউন্ট থেকে করা
হয়েছিল, গত এক সপ্তাহে টুইটার তার সবগুলো বন্ধ করে দেয়। তবে বেনামি ঐসব
আ্যকাউন্টধারীরা হুমকি দিয়েছে তারা আবার হাজির হবে। অধিকার
আন্দোলনকারীরা বলেন, নারীদের ‘ছোটো করতে, অপমান করতে, উস্কানি দিতে এবং
শেষতক তাদের চুপ করিয়ে দিতে’ অনলাইনে এসব গালিগালাজ কাজ করে।
ভারতে অনলাইনে অপদস্থ করা নিয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গত বছরের
এক রিপোর্টে বলা হয় যেসব নারীরা যত বেশি সোচ্চার, তারা তত বেশি টার্গেট
হচ্ছেন। ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে যেমন সোচ্চার কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা বেশি
করে টার্গেট হন, ভারতের ক্ষেত্রে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং নিঁচু বর্ণের
নারীরা বেশি অপদস্থ-অপমানের শিকার হন।
লেখক এবং ভারতে অ্যামনেস্টির সাবেক মুখপাত্র নাজিয়া ইরাম বলেন, এমনিতেই
মুসলিম নারীরা ভারতে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুবই কম রয়েছেন, আর যারা আছেন
তাদের শিকার এবং সন্ত্রস্ত’ করা হচ্ছে। সুপরিকল্পিত এসব আক্রমণের
লক্ষ্যই হচ্ছে শিক্ষিত সেইসব মুসলিম নারী – যারা তাদের মতামত প্রকাশ
করেন, ইসলাম বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কথা বলেন – তাদের মুখ থেকে মাইক্রোফোন
ছিনিয়ে নেয়া। তাদেরকে অপমান করে, তাদের লজ্জায় ফেলে মুখ বন্ধ করার
চেষ্টা হচ্ছে।’
হাসিবা আমিন বলেন এসব অপদস্থকারীদের ‘কোনো ভয়-ডর নেই কারণ তারা জানে
তাদের কিছুই হবেনা।’ তিনি বলেন, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বেশ কিছু
সহিংসতা হয়েছে ক্ষমতাসীন বিজেপির সমর্থকদের উস্কানিতে। যেমন, একজন
মুসলিমতে হত্যায় অভিযুক্ত আটজন কট্টর হিন্দুর গলায় সম্প্রতি মালা
পরিয়েছেন সরকারের একজন মন্ত্রী। নতুন সম্প্রচার মন্ত্রী হয়েছেন যিনি –
তাকে গত বছর ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে। সেখানে তিনি হিন্দুদের
একটি সমাবেশ থেকে ‘মুসলিমদের গুলি’ করতে বলছেন।
সুল্লি ডিলসে যে সব নারীদের ছবি ছাপিয়ে তাদের নিলামে তোলা হয়েছে,
বিচারের জন্য তাদের লড়াই খুবই দীর্ঘ এবং কঠিন হবে। কিন্তু তাদের অনেকেই
এককাট্টা। ‘পুলিশ যদি এই অপরাধীদের খুঁজে নাও পায়, আমি আদালতে যাবো,’
বলেন হানা খান। ‘আমি এর শেষ দেখে ছাড়বো।’ সূত্র : ট্রিবিউন, বিবিসি।