শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ০২:৪৯ অপরাহ্ন

দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি ও সাধক পুরুষ ভবা পাগলার জীবনী

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১
  • ১৩৫ বার পঠিত

 

স্টাফ রিপোর্টার জসীমউদ্দীন ইতি

বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার দু’দেশের দু’বাংলার জনপ্রিয় গীতিকার সুরকার
শিল্পী ও সাধক পুরুষ ভবেন্দ্র মোহন সাহা যাকে সবাই ভবা পাগলা নামেই
খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে।

ভবা পাগলা (১৮৯৭-১৯৮৪) আসল নাম ‘ভবেন্দ্র মোহন সাহা’। তার জন্ম আনুমানিক
১৮৯৭ খৃস্টাব্দে। তার পিতার নাম ‘গজেন্দ্র কুমার সাহা’। ভবা পাগলারা
ছিলেন তিন ভাই এক বোন। তিনি দেখতে ছিলেন একরকম হালকা পাতলা গড়ন, গায়ের রঙ
উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চিবুকে এক গোছা দাঁড়ী।

গানের ভণিতায় তিনি নিজেকে ভবা বা ভবেণ বলে উল্লেখ করেছেন। মানিকগঞ্জ
অঞ্চলে তিনি ভবা পাগলা নামে খ্যাত। তাঁর গান মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন ও
অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ছিল অনেক আগেই।
অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ‘বাংলার বাউল ও বাউল গানে’ তাঁর দুটি গান
ছেপেছিলেন। মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন ‘হারামণির সপ্তম খণ্ডে’ ভবা পাগলা
সম্পর্কে লিখেছেন, ভবা পাগলা এক জন নামকরা বাউল গান রচয়িতা।

তিনি সাটুরিয়া থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত (বর্তমানে ধামরাই
উপজেলার আমতা) গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। স্বাধীনতার পর (অর্থাৎ ১৯৪৭ এর পর
১৯৭১) তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। তাঁর গান মানিকগঞ্জ জেলা
সহ বাংলাদেশ ও ভারতে বিভিন্ন স্থানে পরিচিতি লাভ করে ও গীত হয়ে আসছে।
তিনি মূলত শ্যামা সঙ্গীত, ভাব গান, গুরুতত্ত্বের গান, দেহতত্ত্বের গান, ও
সৃষ্টিতত্ত্বের গান রচনা এবং সুর নিজেই করেছেন।

তিনি ১৯৪৭-এ ভারতে চলে যান এবং বর্ধমানে কালনাতে অবস্থান করতেন। ভবা
পাগলা ১৯৮৪ খৃস্টাব্দে দেহ ত্যাগ করেন।

ভবার পুঁথিগত শিক্ষা অষ্টম শ্রেণীর চৌকাঠ পেরোয়নি। তবে জীবন বোধে যে
অমরত্ব লাভ করেছে, তার পুঁথিগত শিক্ষায় জ্ঞান লাভের প্রয়োজনও বিশেষ
ছিলনা। ছেলেবেলা থেকেই পরিবারের সহবতে, ভক্তিভাব ছিল ভবার সঙ্গী। গ্রাম্য
ভাষায় মুখে মুখে গান বাধা স্বভাব ছিল ভবার। গানের কথার সাথে সুর মিলতো
দুই প্রিয় সহচরীর মতো। গানের স্রোতে তারা খেলে বেড়াতো স্বকীয়তায়। অন্তরের
সবচেয়ে গভীর জমিতে গড়ে তুলতো অন্তর্যামীর আশ্রয়। বাংলার সংগীত জগতে তো
বটেই, বিশ্বের নিরিখেও ভবা পাগলা এক অনন্য নজির।

তথ্য বলছে ভবা পাগলার গানের সংখ্যা ছিয়াশি হাজার। ছিয়াশি হাজার সংখ্যাটা
হয়তো অতিরঞ্জিত। গবেষণা বলে, ভবার গানের সংখ্যাটা আসলে দশহাজার। এই
সংখ্যাটাও বিপুল। এতো বিপুল সংখ্যক লোকগানের জনক কেন বিস্মৃতপ্রায়? সহজ
উত্তর হলো ভবার প্রচারবিমুখতা। তার এই প্রচারবিমুখতার জন্যে, তার জীবনের
অনেক ঘটনাই বিতর্কের বেড়াজালে আটকে পড়েছে।

বাউলদের এক অংশ তাকে নিজেদের বলে দাবি করেন। যদিও অধিকাংশের মতে ভক্তিরস
থাকলেও ভবা পাগলা তার গানে বাউল ধর্মের প্রভাবকে প্রকট হতে দেননি।
জাত-পাতে অবিশ্বাসী ভবার কাছে অন্তরের শুচিতাই ছিল গানের মূল আলেখ্য।
তাইতো অক্লেশে তিনি লিখতে পেরেছেন “দূর করে দে মনের ময়লা”। কোথাও গিয়ে এই
গানের আবেদনে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পরে। মনে পরে কবিগুরু কেমন একই ভাবে
বলেছেন “সংসার যবে মন কেড়ে লয়… জাগেনা যখন প্রাণ”।

গঙ্গার এপার আর পদ্মার ওপারের গান, দুই বাংলার চেতনাকে, একই মালায় বেঁধে
রেখেছে। একজন গায় লালন আর একজন শীতল হয় রবীন্দ্রনাথে। ভবার গানেও মিশে
যায় বিষাদ-অভিমান। পরিচয় ঘটে নিজের আত্মার সাথে।
সাধক কবি ভবা পাগলা বলতেন, ঈশ্বরকে খুঁজতে এদিক ওদিক দৌড়ে যাওয়ার কোনও
দরকার নেই। একাগ্র চিত্তে চোখ বুজে তাঁকে স্মরণ করলেই তাঁকে পাওয়া যায়।
এই পাওয়ার অর্থই হচ্ছে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা, অনুভব করা। যা ঈশ্বরের সঙ্গে
আমাদের অন্তরাত্মার মিলন ঘটায়।

ঘটনাচক্রে ভবা পাগলা একবার নন্দলাল দাস নামের এক দূরারোগ্য রুগীকে ঠিক
করে দেন। এই ঘটনার পরবর্তী সময়ে অনেকেই ভবাকে ঈশ্বররূপে পূজা করতে থাকেন।
প্রতিষ্ঠা পায় ভবার হরবোলা মন্দির। ১৯৮৪ তে ভবা পাগলা শেষ নিঃশাস ত্যাগ
করেন। তবে বাংলা লোকসংগীত যতদিন থাকবে ততদিন বারে বারে বলতে হবে-

তুমি ভেবেছো কি মনে
এই ত্রিভুবনে তুমি যাহা করে গেলে,
কেহ জানেনা ?

এমন সাধের জনম
এমন মানব জনম আর পাবেনা
বারে বারে আর আসা হবে না।।

তুমি যাহা করে গেলে আসিয়া হেথায়
চিত্র গুপ্ত লিখিয়া ভরিলে খাতায়।
তোমার বিচার করিবেন সেই বিধাতায়
তাঁর কাছে ফাকি-জুকি কিছুই চলেনা।
বারে বারে আর আসা হবে না।।

তুমি যাহা বদনে কর নাই প্রকাশ
অন্ত আত্মার কাছে কিযে সর্বনাশ।
জুড়িয়া রয়েছে হৃদয় আকাশ
মানুষের কূলে আর কালী দিওনা।
বারে বারে আর আসা হবে না।।

সাবধানে চলো মন হও হুশিয়ার
তোমার বেলা যে বয়ে যায় আসে অন্ধকার।।
মানুষ দেবতা হয়, হয় অবতার
ভবা কহে চোখ মেলে চেয়ে দেখোনা।।
বারে বারে আর আসা হবে না।।

প্রতিবছর বাংলাদেশের ধামরাই উপজেলার আমতা গ্রামে বৈশাখ মাসের শেষ শনিবার
তার জন্মস্থানে তার প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে বাৎসরিক পূজোৎসব ও ভা পাগলার মেলা
অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে সেই সাথে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। হাজার হাজার ভক্তবৃন্দের
উপস্থিতিতে ভবা পাগলার প্রাণবন্ত হয়ে উঠে উক্ত ভবা পাগলার অঙ্গন।
জাতি,ধর্ম,বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধরনের মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ভবা
পাগলার মেলায় মিলিত হয়।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এ জাতীয় আরো খবর..