ডুমুরিয়ার সালতা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিলের পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
কাজী রায়হান তানভীর সৌরভ
খুলনা প্রতিনিধি,
বাড়ির উঠানে পানি। উঁচু করে কাঁচা ঘর বানিয়ে রাখা হয়েছে গবাদি পশু। সেখানেও পানি ছুঁইছুঁই। রাস্তা থেকে ঘরে ওঠার জন্য তৈরি করা হয়েছে বাঁশের সাঁকো। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতেও ব্যবহৃত হচ্ছে সাঁকো। এমন অবর্ণনীয় দুর্ভোগের চিত্র খুলনার ডুমুরিয়াসহ আশপাশের ছয় উপজেলার মানুষের। বিল ডাকাতিয়াবেষ্টিত ১৫ লক্ষাধিক মানুষ দেড় মাস ধরে এভাবে পানিবন্দী হয়ে রয়েছে।
স্থায়ী জলাবদ্ধতার মূল কারণ দক্ষিণাঞ্চলের ৮০ ভাগ নদী ভরাট হয়ে বিলের চেয়ে উঁচু হওয়া। ফলে প্রবাহের সব পথ প্রায় বন্ধ। এলাকাবাসীর দাবি ভরাট নদী খনন করে জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনলেই চরম এ দুর্ভোগের হাত থেকে মানুষের মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
সরেজমিন দেখা জানা যায়, খুলনার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, পাইকগাছা, তালা, কেশবপুর, মনিরামপুর, অভয়নগরসহ কয়েকটি উপজেলার অধিকাংশ এলাকার জনগণ চলতি বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলার শলুয়া, আন্দুলিয়া, দেড়লী, কৃষ্ণনগর, বারানসি, বটবেড়া, মোজারঘোটা, সাড়াভিটা ও রংপুর, ফুলতলা উপজেলার জামিরা, সাতিয়ানি ও গাড়াখোলা এলাকা বিল ডাকাতিয়ার অংশ। ওই এলাকার ১২ কিলোমিটার রাস্তার দুইপাশেই মিলবে এমন অসংখ্য বাড়ি, যা পানির মধ্যে নিমজ্জিত। এমনকি রাস্তার কোথাও কোথাও ডুবে গেছে হাঁটু পানিতে। এ চিত্র দেড় মাস ধরে চলছে।
ডুমুরিয়ার নরনিয়া স্লুইস গেট এলাকার ক্যাচমেন্ট এলাকা প্রায় ৭০০০ হেক্টর। যশোরের কেশবপুর, সাতক্ষীরার তালা ও খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৫১টি গ্রামের পানি এই স্লুইস গেট দিয়ে নিষ্কাশিত হয়। উপরের বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিম্ন অববাহিকায় এসে মহাপ্লাবন সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ডুমুরিয়া উপজেলার আটলিয়া ও মাগুরাঘোনা ইউনিয়ন, তালা উপজেলার তালা ও তেঁতুলিয়া ইউনিয়ন এবং কেশবপুর উপজেলার বিদ্যানন্দকাটি ইউনিয়নের বড় অংশের এলাকার জীবনযাত্রা থমকে গেছে। প্রায় দেড় মাস ধরে এ অবস্থা চললেও বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো পানি নিষ্কাশন করা সম্ভব হয়নি।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে গত রোববার পর্যন্ত খুলনায় মোট ৬৬০ মিলি মিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণ।
এবারের অতি বৃষ্টি ছাড়াও উত্তরের পানি প্রবাহ কম থাকায় স্থানীয় নদীগুলো বিশেষ করে কপোতাক্ষ, হামকুড়া, ভদ্রা, শ্রীহরি প্রভৃতিতে পলি জমে নাব্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনার প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহা।
তিনি বলেন, এর একটি সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের। অন্যগুলো আমাদের হাতে। আমাদের হাতে যেগুলো সেগুলোর চেষ্টা চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ডুমুরিয়া এলাকায় ১৭টি পাম্প বসিয়ে পানি নিষ্কাশনের পাশাপাশি শৌলমারী নদীর নিচু এলাকায় খনন কার্যক্রম চলছে। বিল ডাকাতিয়ার পানি তিনটি স্থান থেকে অপসারণ করা হচ্ছে।
তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক জলাবদ্ধতার ফলে শুধুমাত্র খুলনার ডুমুরিয়া এলাকায়ই ৮০০ হেক্টর জমি প্লাবিত হয়েছে।
হামকুড়া নদী খনন বাস্তবায়ন কমিটির সহসভাপতি অধ্যাপক জি এম আমান উল্লাহ বলেন, ভরাট নদী দখলমুক্তপূর্বক খনন করে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করার মাধ্যমে জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব।
এদিকে, উত্তরণ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলার ছয়টি উপজেলার প্লাবিত ২০৭টি গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের চিত্র। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ১৫ লাখ মানুষ।