মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ০২:৪৩ অপরাহ্ন

অধশতাধিক বয়সে মাস্টার্স পাস

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৫ জুলাই, ২০২২
  • ১৪৫ বার পঠিত

অধশতাধিক বয়সে মাস্টার্স পাস
জসিম উদ্দীন ইতি ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
মাত্র ৪ বছর বয়সে মাকে হারান আরেফা হোসেন। চার বছর পর বয়স যখন আট তখন
হারান বাবাকে। পাঁচ বোনের মধ্যে আরেফা ছিল তৃতীয়। অভিভাবক হিসেবে একমাত্র
বড় বোন। কিন্তু এতেও ভাগ্যে আসে বিয়োগের বেদনা। অল্প বয়সে বড় বোনের বিয়ে
হয়ে যায়। পরে তার বাকি তিন বোনসহ আশ্রয় হয় একটি অনাথ আশ্রমে।
অনাথ আশ্রম থেকে ভর্তি হন মিশনারি স্কুলে। মাধ্যমিকে পড়াশোনা করার সময়
বাংলা একটি সিনেমা দেখেন তিনি। যে সিনেমায় এক এতিম মেয়ে স্বেচ্ছায়
মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। সে সিনেমা থেকেই স্বপ্ন বুনতেন- তিনিও একদিন
সেবিকা হবেন। ১৯৭৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে রাজশাহীর খ্রিস্টিয়ান মিশন
হাসপাতালে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারিতে ভর্তি হোন।
সেখান থেকে ১৯৮১ সালে শেষ করে ১৯৮২ সালের ৬ জুন ঠাকুরগাঁও মহকুমা
হাসপাতালে (বর্তমানে আধুনিক সদর হাসপাতালে) নার্স হিসেবে যোগদান করেন।
চাকরির দুই বছর পরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বছর না যেতেই কোলজুড়ে
আসে সন্তান। যেন বেড়ে গেল আরো দায়িত্ব কমে গেল সময়। একদিকে সংসারের
ব্যস্ততা অন্যদিকে কর্মময় জীবন। এগুলো বাদ দিয়ে আলাদা কোন বিষয়ে মনোনিবেশ
হওয়ার সুযোগ ছিলনা তার।
তবে মনে তার সুপ্ত বাসনা তাড়া করতো উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার। সেই
স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে আবার শুরু হয় পড়াশোনা। ১৯৯৬ সালে বিএসসি করার
জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মহাখালী সেবা মহাবিদ্যালয়ে।
সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে স্নাতক শেষ করেও ক্ষান্ত হননি তিনি। পরে ২০১৭-১৮
শিক্ষাবর্ষে অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স
করার জন্য ভর্তি হন। ২০১৯ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করে চলতি বছরের ১৫ জুন
৬২ বছর বয়সে সনদ গ্রহণ করেন তিনি ৷ এই বয়সে আরেফা হোসেনের উচ্চশিক্ষায়
ডিগ্রি অর্জনের বিষয়টি জেলার শিক্ষার্থীদের মাঝে সাড়া ফেলেছে।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভার ইসলামবাগের বাসিন্দা আরেফা হোসেন। ২০১৯ সালের ২৪
অক্টোবর চাকরিজীবনের ইতি ঘটে তার। একই বছরের ৭ নভেম্বর তিনি স্বামীকে
হারান। বর্তমানে দুই ছেলে সন্তান নিয়ে তার পরিবার। ঠাকুরগাঁও আধুনিক সদর
হাসপাতালে ৩৮ বছরের চাকরিজীবন শেষ করে বর্তমানে তিনি ঠাকুরগাঁও নার্সিং
সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত আছেন।
আরেফা হোসেন বলেন, আমার জন্ম নাটোর জেলায়। সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিল। আমরা
পাচঁ বোন ছিলাম। ছোট বেলায় মা-বাবা মারা যায়। বড় বোন আমাদের দেখাশোনা
করতেন। কিছুদিন পর বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তখন আমাদের দেখাশোনা করার মতো
কেউ ছিল না। আমিসহ আমরা তিন বোন সেখানে এক অনাথ আশ্রমে থাকা শুরু করি।
সেই অনাথ আশ্রমেই সময়টা কেটেছে। এক বদ্ধপরিকর জীবন কেটেছে আমাদের। যেহেতু
এতিম, সেহেতু এর বাইরে আলাদাভাবে জীবন কাটানোর কোনো সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
ছোটবেলায় সবার মনে বড় হয়ে কিছু হওয়ার ইচ্ছে থাকে। তবে আমার স্বপ্ন বা
ইচ্ছাটা ছিল একটু অন্যরকম। যেহেতু মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছি সেখানেই
থেকেছি। আমি একটি বাংলা সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমায় দেখানো হয়- এক বাবা-মা
হারা মেয়ে মানুষকে সেবা দিচ্ছে। সেই সিনেমার ওই চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত
হয়ে আমিও মনে মনে ভেবেছিলাম যে, মানুষের সেবা করব। সেবিকা হিসেবে আমিও
মানুষের পাশে থাকব। তারপর নার্সিং কলেজে ভর্তি হই। সেখানে পড়াশোনা শেষ
করি।
তিনি বলেন, যখন মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন খুব অসহায় হয়ে যায়। তিনি যে
পরিবারের হোক বা যতই ধনবান হোক। এ পেশায় থাকাকালীন বিভিন্ন রোগী ও তাদের
পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়েছে। মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকায় সেবিকা
পেশাটা মহৎ পেশা বলে আমি মনে করি। যে পেশায় মানুষকে খুব কাছ থেকে
সহযোগিতা করা যায়।
আরেফা হোসেন আরও বলেন, আমার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা গ্রহণ
করার। কিন্তু চাকরির পর বিয়ে তারপর সন্তান হয়ে যায়। মনে হয়েছিল হয়তো আর
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব না। তবে আমার স্বামী আমাকে সাহস দিয়েছেন।
তার অনুপ্রেরণায় আমি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছি। তিনি আমাকে বলেছিলেন-
উচ্চশিক্ষার যেহেতু সুযোগ আছে তুমি ভর্তি হয়ে যাও। আমি এই বয়সে মাস্টার্স
করেছি আমার স্বামীর অনুপ্রেরণায়। যদিও তিনি আমার সফলতা দেখে যেতে
পারেননি। ২০১৯ সালে তিনি মারা গেছেন। আর আমি এ বছরে মাস্টার্স শেষ করে
সনদ পেয়েছি। আসলে জীবন মানে সংগ্রাম। কথায় আছে যে রাধে, সে চুলও বাঁধে।
সংসার আর চাকরির সঙ্গে পড়াশোনাটা একটা যুদ্ধের মত ছিল। যদি মানুষ ইচ্ছে
করে আর পরিশ্রম করে, তবে সফল হওয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি।
তিনি বলেন, এই বয়সে পড়াশোনা করতে অনেক পরিশ্রম হয়েছে। এত বেশি চাপ নিতে
হয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সফলতার সনদ পেয়ে সব কষ্ট হারিয়ে
গেছে। আমার দুই ছেলে। ছোট ছেলে প্রথমদিকে বিষয়টিকে আলাদাভাবে দেখলেও এখন
অনেক খুশি। আর আমার বড় ছেলে বলে- আম্মু তুমি আর আমি একসঙ্গে পিএইচডি করব।
তারা অনেক খুশি হয়েছে।
ঠাকুরগাঁও নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজের শিক্ষার্থী সানিয়া
আক্তার বলেন, আমাদের কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ম্যাম চাকরি করছেন। অনেক
সুন্দর করে তিনি আমাদের ক্লাসে পাঠদান করান। উনার ক্লাসে মনোযোগ থাকলে
আলাদাভাবে বাড়তি পড়াশোনার প্রয়োজন হয় না। আর উনি আমাদের অনুপ্রেরণা। এই
বয়সে যদি ম্যাম উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে আমরাও পারব। আমরা
সকলে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ম্যামের সফলতা দেখে
ইসলামবাগের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুল লতিফ বলেন, আরেফা হোসেন
অনেক শিক্ষার্থীর চোখ খুলে দিয়েছেন। অনেকে বয়স হয়ে গেলে উচ্চশিক্ষা থেকে
পিছিয়ে যায়। তারা মনে করে তাদের দিয়ে সম্ভব না। আরেফা হোসেন তাদের জন্য
দৃষ্টান্তও বটে।
আরেফা হোসেনের ছোট ছেলে আদিব হোসেন বলেন, আম্মুর সফলতায় আমরা অনেক খুশি।
আমরা সন্তান হিসেবে আম্মুকে নিয়ে গর্ববোধ করেছি। আমরা মা-ছেলে একসঙ্গে
পিএইচডি করব।
ঠাকুরগাঁও পৌরসভার কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বলেন, আরেফা হোসেন প্রমাণ করে
দিয়েছেন বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। যদি স্বপ্ন দেখা যায় আর পরিশ্রম করা হয়,
তবে সফল হওয়া সম্ভব। আমি তার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি। তিনি
যাতে তার অর্জিত শিক্ষা নতুন প্রজন্মের কাছে বিলিয়ে দিতে পারেন সেই কামনা
করি।

নিউজটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এ জাতীয় আরো খবর..